Tuesday, August 9, 2011

সহজ ভাষায় বাংলা কবিতার ছন্দ শিক্ষা

        কবিতা লেখা আজকাল মানুষের কাছে একরকম খেলা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেখা যাচ্ছে, কেউ একটু লেখাপড়া শিখেই মনের মাধুরী মিশিয়ে কবিতা লেখা শুরু করে দিচ্ছে। কি লিখছে নিজেও বুঝতে পারছে না। এদিকে আবার, নিজেকে কাজী নজরুল ইসলাম ভেবে বসে আছে। এতে করে, কবিতা তার আসল মহত্ব হারাচ্ছে। এর মূল কারন, এদের কেউই বাংলা কবিতার ছন্দ সম্পর্কে জানে না। মনে রাখা উচিত, সব কিছুরই একটা নিয়ম আছে। কবিতা লেখাও তার ব্যতিক্রম নয়। যেমন, কেউ সাঁতার কাটতে জানেনা তবুও পানিতে নামল, তাহলে তার অবস্থাটা কি হবে একবার ভাবুন! তাই চলুন, বাংলা কবিতার ছন্দ সম্পর্কে সামান্য কিছু ধারনা নেয়ার চেষ্টা করি। এর জন্য আমরা সবাই নিজেকে এমন ভাবে প্রস্তুত করি যেন, ছন্দ সম্পর্কে একটা পরিপূর্ণ ধারনা নিতে পারি।   

         এটি মূলত তিন প্রকার। যথাঃ
                   ১. স্বরবৃত্ত ছন্দ।
                   ২. মাত্রাবৃত্ত ছন্দ।
                   ৩. অক্ষরবৃত্ত ছন্দ।

নামগুলো হয়তো আমাদের সবারই চেনা। কিন্তু, এদের প্রকৃত ব্যবহার আমাদের অনেকেরই জানা নেই। তাই চলুন, এ সম্পর্কে জানার চেষ্টা করি।

        ছন্দ সম্পর্কে জানার আগে চলুন, আমরা প্রথমে কিছু চিহ্ন সম্পর্কে জেনে নেই। আসলে, এগুলোর সঠিক ব্যবহারের উপর ভিত্তি করেই আমরা ছন্দ চিনব। এগুলো একেক ছন্দে একেকভাবে ব্যবহৃত হয়, আর এদের সুষ্ঠু ব্যবহার কবিতাকে করে তোলে সার্থক ও শ্রুতিমধুর। এগুলো হল, ‘‘অক্ষর”, ‘‘মাত্রা”, ‘‘মুক্তাক্ষর”, ‘‘বদ্ধাক্ষর বা যুক্তাক্ষর”, ‘‘পর্ব”, ‘‘অতিপর্ব” ইত্যাদি। আপাতত এই কয়টি জানলেই চলবে। চলুন, এখন এগুলো নিয়ে আলোচনা করা যাক।

        সবার আগে অক্ষর নিয়ে আলোচনা করতে চাই। সাধারণ ভাবে আমরা বুঝি, প্রতিটি বর্ণই একেকটি অক্ষর। কিন্তু, বাংলা ব্যকরণের ভাষায় তা প্রকৃতপক্ষে সঠিক নয়। আমরা জানি, মানুষ মনের ভাব প্রকাশের জন্য মুখ থেকে যে সকল শব্দ বা আওয়াজ বের করে তাই ধ্বনি। আবার, ধ্বনির লিখিত রূপই হল বর্ণ। কিন্তু, মানুষ কোন শব্দ উচ্চারণ করার সময়, একবারে যত গুলো কম সংখ্যক বর্ণ উচ্চারণ করে, তাদের একেকটিকে একেকটি অক্ষর বলে। চলুন, আমরা একটি উদাহরণের মাধ্যমে বোঝার চেষ্টা করি। এর জন্য আমরা ‘‘কলম” শব্দটি বাছাই করলাম। আপনাদের বোঝার সুবিধার্থে, এই একটি শব্দই উদাহরণে ব্যবহার করার চেষ্টা করব। এবার কাজের কথায় আসি। খেয়াল করে দেখুন, ‘‘কলম’’ শব্দটি আমরা দুই ভাগ করে উচ্চারণ করছি ‘‘ক”, ‘‘লম্” এভাবে। শুধুমাত্র ‘‘কলম” শব্দটিই নয়, প্রতিটি শব্দই, আমরা এমন ভাগ ভাগ করেই উচ্চারণ করি। এই প্রতিটি ভাগই হল একেকটি অক্ষর। মাত্রা নিয়ে আলোচনার সময় বিষয়টি আরো পরিষ্কার হয়ে যাবে। তাহলে এবার চলুন, আমরা মাত্রা শিখে ফেলি।    

         সাধারণত কোন একটি শব্দের প্রতিটি অক্ষরকেই, একমাত্রা বলে বিবেচনা করা যায়। বুঝতে সমস্যা হচ্ছে কী??? সমস্যা হলেও সমস্যা নেই। চলুন উদাহরণে যাই, তাহলেই ঠিক হয়ে যাবে। চলুন, আমরা ‘‘কলম’’ শব্দটি উচ্চারণ করি ‘‘ক’’, ‘‘লম্’’ এভাবে। আপনি নিজে একবার বলার চেষ্টা করুন। খেয়াল করুন, আপনি কিন্তু ‘‘ক’’ ‘‘ল” ‘‘ম’’ এভাবে বলছেন না। ‘‘ক’’, ‘‘লম্’’ এভাবেই বলছেন। সুতরাং ‘‘ক’’ একটা মাত্রা এবং ‘‘লম্’’ একটা মাত্রা। এখন কি কিছু বোঝা যাচ্ছে??? আপনারা হয়ত ভাবছেন, অক্ষর এবং মাত্রার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। কিন্তু, এদের মধ্যেও পার্থক্য আছে। আসলে অক্ষরের ধারনা থেকেই মাত্রার উৎপত্তি। কখনো কখনো, একটি অক্ষরে দুই মাত্রাও হতে পারে। আমি মনে করি, এখনি বিষয়টিকে এতো জটিল করে ভাবার কোন কারণ নেই। তারচেয়ে চলুন, মাত্রার স্পষ্ট ধারনা নিতে আমরা আরও কিছু শব্দ পর্যবেক্ষণ করি। যেমন, খাতা = খা, তা ; গীটার = গী, টার ; ক্যালকুলেটর = ক্যাল, কু, লে, টর ; হাইফেন = হাই, ফেন ইত্যাদি। এখানে, খাতা দুই মাত্রা, গীটার দুই মাত্রা, ক্যালকুলেটর চার মাত্রা, হাইফেন দুই মাত্রা।
আশাকরি, আমরা মাত্রা সম্পর্কে অনেক কিছু শিখে ফেলেছি। মনে প্রশ্ন জাগছে কী? এক বর্ণ বিশিষ্ট অক্ষরও এক মাত্রা, আবার দুই বর্ণ বিশিষ্ট অক্ষরও এক মাত্রা, ঘটনা কী??? আসলে, মাত্রা বর্ণের পরিমাণের উপর না, বলার ভঙ্গির উপর নির্ভর করে।
    
        এবার, মুক্তাক্ষর নিয়ে আলোচনা করা যাক। যখন একটি অক্ষরে একটিই বর্ণ থাকে, তখন তাকে মুক্তাক্ষর বলে। যেমন, ‘‘কলম” শব্দটিকে বিশ্লেষণ করলে দুটি অক্ষর ‘‘ক’’, ‘‘লম্’’ পাওয়া যায়। এতে, ‘‘ক” একাই একটি অক্ষর, সুতরাং এটি মুক্তাক্ষর।
        
        এবার, যদি একাধিক বর্ণ মিলে একটি অক্ষর বুঝায়, তাকে বদ্ধাক্ষর বলে। সুতরাং, ‘‘কলম” এর ‘‘লম্’’ হল বদ্ধাক্ষর। এখন, একটি বড় শব্দের ক্ষেত্রে বোঝার চেষ্টা করি। যেমন, প্রত্যুৎপন্নমতি = প্রত্, তুৎ, পন্, ন, ম, তি। এখানে, ন, ম, তি এই তিনটি মুক্তাক্ষর এবং প্রত্, তুৎ, পন্, এই তিনটি বদ্ধাক্ষর। আশাকরি, মুক্তাক্ষর আর বদ্ধাক্ষর চিনতে আপনাদের আর কোন সমস্যা হবে না। 

       এবার পর্ব নিয়ে আলোচনা শুরু করছি। পর্বের সংজ্ঞা দিতে বলা যায়, এক নিঃশ্বাসে যতগুলো কম সংখ্যক শব্দ একবারে পড়া যায়, তাদের সমষ্টি হল একটি পর্ব। বুঝিনাই!!! চলুন আমরা উদাহরণে যাই। যেমন,
                   
                      ঐ খানে তোর / দাদির কবর /
                      ডালিম গাছের / তলে /
এখানে, প্রতিটি ( / ) চিহ্নের মধ্যের শব্দ সমষ্টিই এক একটি পর্ব। যেমন, (ঐ খানে তোর, দাদির কবর, ডালিম গাছের) এই তিনটি একেকটি পরিপূর্ণ পর্ব। এখন প্রশ্ন হচ্ছে পর্বতো বুঝলাম, তাহলে শেষের ‘‘তলে” কথায় গেল ? ওরকি পা আছে যে হেঁটে চলে যাবে! নাকি তার ডানা আছে, যে উড়ে যাবে। এটাও বলছি, তার আগে অতিপর্বের সংজ্ঞা দিয়ে নেই।
        
        যখন, একটি শব্দ নিয়ে একটি পর্ব বুঝাবে, তখন তাকে আমরা অতিপর্ব বলব। সুতরাং, এখানে ‘‘তলে” হল, অতিপর্ব। একে অপূর্ণ পর্বও বলা যেতে পারে। এখন চলুন আমরা আরেকটি কবিতা দেখি,
                      
                      এই নেয়েছে / ঐ নিল যাঃ / কান নিয়েছে / চিলে /
                      চিলের পিছে / মরছি ঘুরে / আমরা সবাই / মিলে /

নিশ্চই বুঝতে পারছেন, ‘‘চিলে” এবং ‘‘মিলে” হল অতিপর্ব, বাকি গুলো পর্ব। সুতরাং, এই দুটি লাইনে ছয়টি পর্ব এবং দুইটি অতিপর্ব আছে।

( বিঃ দ্রঃ -
          ১. পর্ব বোঝানোর জন্য ( / ) চিহ্ন, মাত্রা বোঝানোর জন্য অক্ষরের উপর ( U ) চিহ্ন এবং এক ও দুই মাত্রা বোঝানোর জন্য ( - ) চিহ্নের উপর যথাক্রমে এখানে ( । ) বা ( ।। ) চিহ্ন ব্যবহার করা যেতে পারে। 
          ২. মুক্তাক্ষরে কখনো দুই মাত্রা হতে পারে না। কিন্তু বদ্ধাক্ষরে দুই মাত্রাও হতে পারে।
          ৩. লেখার কিছু কিছু ক্ষেত্রে ‘‘আনুসঙ্গিক পর্ব” কথাটি ব্যবহার করা হয়েছে। এর দ্বারা পরষ্পর বৈশিষ্ট্য পূর্ণ বা সমান মাত্রা বিশিষ্ট্য পর্বকে বোঝানো হয়েছে। )

        আমার মনে হচ্ছে, আপনারা আমার উপর বিরক্ত হচ্ছেন, তাইনা??? মনে মনে বলছেন, লোকটা শুধু পেঁচাচ্ছে, কাজের কথায় আসছেনা। চিন্তা করবেন না, আমার সকল আনুসঙ্গিক কথাবার্তা শেষ। তাহলে, চলুন আমরা এবার বাংলা কবিতার ছন্দ শিখি। 
    
 স্বরবৃত্ত ছন্দঃ
               সাধারণত ছড়া জাতীয় কবিতাগুলো স্বরবৃত্ত ছন্দের হয়। কিন্তু, এটা এর প্রধান বৈশিষ্ট্য নয়। প্রকৃতপক্ষে স্বরবৃত্ত ছন্দের কবিতা হল, যে সকল কবিতার মুক্তাক্ষর ও বদ্ধাক্ষরে একমাত্রা হয়, তাকে স্বরবৃত্ত ছন্দের কবিতা বলে। এ ক্ষেত্রে প্রতিটি লাইনে সাধারণত মাত্রা সংখ্যা সমান থাকে। যেমন, এই কবিতাটি হয়তো বা ছোটবেলায় আমরা সবাই পড়েছি, 
                     
                      ‘‘খোকন খোকন ডাক পারি
                               খোকন মোদের কার বাড়ি”

চলুন কবিতাটি বিশ্লেষণ করি।
                      ।    ।   ।    ।      ।     ।  ।   
                      খো কন খো কন /  ডাক পা রি /
                       ।   ।    ।   ।      ।    ।  ।       
                      খো কন মো দের / কার বা ড়ি /

কী, বোঝা যাচ্ছে ? এখানে, ( খোকন খোকন, খোকন মোদের ) পরষ্পর আনুসঙ্গিক পর্ব এবং দেখুন প্রতিটি পর্বই চারমাত্রা করে। আবার, ( ডাক পারি, কার বাড়ি ) পরষ্পর আনুসঙ্গিক পর্ব এবং এরা প্রত্যেকেই তিনমাত্রা করে। এখন খেয়াল করে দেখুন, প্রতিটি লাইনে ৪ + ৩ = ৭ মাত্রা। সুতরাং, আমরা এই সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে, এটা স্বরবৃত্ত ছন্দ।
         
       তাহলে বোঝা গেল, ছন্দ চেনার জন্য আগে পর্বে ভাগ করতে হবে, তারপর মাত্রায় বিভক্ত করতে হবে। এরপর মাত্রা গুনে সিদ্ধান্তে আসতে হবে। আমরা কিন্তু স্বরবৃত্ত ছন্দ শিখে ফেলেছি। কী, আনন্দ হচ্ছে??? এখন চলুন আমরা মাত্রাবৃত্ত ছন্দ নিয়ে আলোচনা করি। 

মাত্রাবৃত্ত ছন্দঃ
               সাধারণত গীতিকবিতা গুলো মাত্রাবৃত্ত ছন্দের হয়ে থাকে। যে সকল কবিতায়, বদ্ধাক্ষরে দুইমাত্রা এবং মুক্তাক্ষরে একমাত্রা হয়, তাদের মাত্রাবৃত্ত ছন্দের কবিতা বলে। বদ্ধাক্ষরেও যে দুই মাত্রা হয়, মাত্রাবৃত্ত ছন্দ তার প্রমাণ। এখানে বদ্ধাক্ষর, মুক্তাক্ষরের আগে, মধ্যে বা পরে যেখানেই থাকুক না কেন, বদ্ধাক্ষরে দুই মাত্রা হবে। আচ্ছা বলুনতো, যদি বদ্ধাক্ষরে একমাত্রা হত তাহলে কি হত? ভুলে গেলে আগের পৃষ্টা গুলো আবার পড়ুন, আর যদি সে ধৈর্য্য না থাকে, তাহলে আমার সাথে এগিয়ে চলুন। তাহলে, এক্ষেত্রে হবে স্বরবৃত্ত ছন্দ। আগের কথাগুলো আপনাদের সুবিধার্থে আরও একবার আলোচনা করে নিলাম। আমার মনে হয়, আপনারা স্বববৃত্ত ও মাত্রাবৃত্ত ছন্দের পার্থক্য বুঝতে পেরেছেন। তাহলে চলুন, আমরা একটা মাত্রাবৃত্ত ছন্দের কবিতা দেখি। যেমন, পল্লী কবি জসীমুদ্দীনের ‘‘কবর” কবিতাটি দেখতে পারি। এটি মাত্রাবৃত্ত ছন্দের কবিতা।
                     
                     ‘‘ঐ খানে তোর দাদির কবর 
                                 ডালিম গাছের তলে
                     তিরিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি
                              দুই নয়নের জলে”।

কবিতা তো দেখা হল, এখন কাজ কী? চলুন বিশ্লেষণ করি। 

                    ।।  ।  ।   ।।     ।  ।।  ।  ।।     
                    ওই খা নে তোর / দা দির ক বর / 
                              ।  ।।   ।  ।।     ।  ।    
                              ডা লিম্ গা ছের / ত লে /
                     ।  ।।  ।  ।।    ।  ।   ।   ।  ।  ।
                     তি রিশ ব ছর / ভি জা য়ে রে খে ছি / 
                             ।।  ।।  ।।    ।  ।
                             দুই নয় নের / জ লে /

দেখুন, এখানে বদ্ধাক্ষরেও দুই মাত্রা পরেছে। শুধু তাইনা, আরও খেয়াল করে দেখুন কোথাও কোথাও বদ্ধাক্ষর মুক্তাক্ষরের আগে আবার কোথাও কোথাও পরে। কিন্তু, মজার বিষয় হল, উভয় ক্ষেত্রেই দুইমাত্রা পরেছে। এটিই মাত্রাবৃত্ত ছন্দের প্রধান বৈশিষ্ট্য।

        আচ্ছা, লাইন দুটিতে দুটি শব্দ আছে ‘‘তলে”, ‘‘জলে”, এদেরকে কি বলা হয় মনে আছে? আরে, এরা হল অতিপর্ব! আমরা কিন্তু মাত্রাবৃত্ত ছন্দও শিখে ফেলেছি, টের পেয়েছেন? মনে হয় না!!! তাহলে এখন বাকি থাকল, অক্ষরবৃত্ত ছন্দ, তাহলেই শেষ। আপনারা যারা ধৈর্য্য ধরে এই সবটুকু পড়েছেন তাদের সবাইকে বলছি, চলুন আমরা অক্ষরবৃত্তটাও শিখে ফেলি। 

অক্ষরবৃত্ত ছন্দঃ
                  বাংলা কবিতার ছন্দে সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় ছন্দ হল এই অক্ষরবৃত্ত ছন্দ। কারন, এটি যত প্রকারে নিজের অস্তিত্ব তুলে ধরেছে, আর কোন ছন্দই তা পারেনি। সুতরাং বুঝতেই পারছেন, অক্ষরবৃত্ত ছন্দের প্রকার ভেদের অভাব নেই। কিন্তু, এ লেখাতে আমরা এর প্রকারভেদ নিয়ে আলোচনা করতে যাবনা। পরবর্তিতে যদি সুযোগ হয়, তাহলে শুধু অক্ষরবৃত্তের প্রকারভেদ নিয়ে একটি লেখা লিখব। এই লেখাতে আমরা শুধু ছন্দ চিনব এবং এর ব্যবহার শিখব। 

        যে সকল কবিতায়, মুক্তাক্ষরে একমাত্রা ও বদ্ধাক্ষর যদি শব্দের শুরুতে (আদিতে) বা মধ্যে থাকে তাহলেও এক মাত্রা হয়, কিন্তু বদ্ধাক্ষর যদি শব্দের শেষে থাকে তাহলে দুইমাত্রা হয়, তাকে অক্ষরবৃত্ত ছন্দ বলে। আমার মনে হয় সংজ্ঞাটি একটু কঠিন হয়ে গেছে। আপনারা সংজ্ঞাটি কয়েকবার করে পড়ুন এবং নিজে বোঝার চেষ্টা করুন। তাতেও যদি না বোঝা যায়, সামনে উদাহরণত দেওয়াই হচ্ছে, তখন ঠিক হয়ে যাবে। আগে এ সম্পর্কে আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়ে নেই, তারপর আমরা উদাহরণে যাব। 

        এর সাথে মাত্রাবৃত্তের সামান্য মিল আছে। এ দুটি ছন্দে একটি প্রধান পার্থক্য হলো, মাত্রাবৃত্ত ছন্দে সর্বদাই বদ্ধাক্ষরে দুইমাত্রা। কিন্তু, অক্ষরবৃত্ত ছন্দে শুধুমাত্র শব্দের শেষের বদ্ধক্ষরে দুইমাত্রা, বাকিগুলো একমাত্রা। তবে হ্যাঁ, যদি একটি পূর্ণ শব্দ একাই একটি বদ্ধাক্ষর হয় তাহলে, অক্ষরবৃত্ত ছন্দের বেলায় ও দুইমাত্রা হবে। এখন আমরা উদাহরণে যেতে পারি। যেমন, আমরা মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘‘বঙ্গভাষা” কবিতাটি দেখব,

                     ‘‘হে বঙ্গ ভান্ডারে তব বিবিধ রতন
                       তা সবে অবোধ আমি অবহেলা করি”
এখন বিশ্লেষণে আসি,
                     ।   ।  ।   ।   ।   ।  । ।   ।   ।  । ।  ।।
                     হে বঙ্ গ ভান্ ডা রে ত ব / বি বি ধ র তন /
                     ।  ।  ।  ।   ।।   ।  ।     ।  ।  । ।  ।  ।
                     তা স বে অ বোধ আ মি / অ ব হে লা ক রি /

এখন চলুন, সংজ্ঞার সাথে মেলানোর চেষ্টা করি। কবিতাটিতে মুক্তাক্ষরে একমাত্রা করে আছে। বদ্ধাক্ষর শব্দের শুরুতেও আছে আবার শব্দের শেষেও আছে। কিন্তু এতে মাত্রাবৃত্তের মত শব্দের শুরু বা মধ্যে বদ্ধাক্ষরে দুইমাত্রা হয়নি বরং শুধু শব্দের শেষের বদ্ধক্ষরে দুইমাত্রা হয়েছে। আশাকরি, আপনারা মাত্রাবৃত্ত ও অক্ষরবৃত্ত ছন্দের মাত্রাগত পার্থক্য বুঝতে পেরেছেন। কিন্তু এছাড়াও, এদের মধ্যে আরো পার্থক্য আছে। সেগুলো আমাদের আপাতত জানার দরকার নেই। শুধু যেসব কথা না বললেই নয়, সেগুলোই বলব। 
        
        আপনারা হয়ত আমার অক্ষরবৃত্ত ছন্দের উদাহরণটি দেখে বলছেন, ‘‘লোকটা বলছে অক্ষরবৃত্ত ছন্দ নিয়ে, আবার উদাহরণ দিচ্ছে ভুল। আরে এটাত সনেট সবাই জানে”। আমিও বলছি, এটা সনেট। তাহলে, আমি এই উদাহরণটি অক্ষরবৃত্ত ছন্দের ক্ষেত্রে দিলাম কেন? এর কারন, আমি আপনাদের বোঝাতে চাইছি অক্ষরবৃত্ত ছন্দ কতটা বিস্তৃত এবং সনেট এই বিস্তৃত অংশের একটি সামান্য অংশ বিশেষ। 

        লেখার শুরুতে আমরা জেনেছি ছন্দ মূলত তিন প্রকার। তবে এখন বলছি দুই প্রকার, স্বরবৃত্ত ছন্দ ও অক্ষরবৃত্ত ছন্দ। তাহলে, মাত্রাবৃত্ত ছন্দ কথায় গেল? আসলে মাত্রাবৃত্ত ছন্দও অক্ষরবৃত্ত ছন্দের একটি অংশ। যখন দেখা গেল কিছু কিছু ক্ষেত্রে কোন কোন কবিতার প্রতিটি বদ্ধাক্ষরেই দুইমাত্রা পরছে, কিন্তু এতে ছন্দের বা কবিতার লয়ের কোন পরিবর্তন হচ্ছে না, তখন একে অক্ষরবৃত্ত ছন্দ থেকে আলাদা করে ফেলা হয় এবং এই বিশেষ বৈশিষ্টের কারনে নাম দেয়া হল মাত্রাবৃত্ত ছন্দ। এভাবেই মাত্রাবৃত্ত ছন্দের উৎপত্তি হয়। 

        এতক্ষন যাবত আমি আপনাদের সামনে বাংলা কবিতার ছন্দ সম্পর্কিত কিছু সাধারণ বিষয় উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছি। তাই আমার দেয়া এই কয়েকটি উদাহরণ পড়ার পাশাপাশি অন্যান্য কবিতা দেখুন। এরপর কবিতাটি নিয়ম অনুসারে বিশ্লেষণ করুন এবং নিজে ছন্দ নিরুপন করার চেষ্টা করুন। এতে ছন্দ সম্পর্কে ধারনা আরো স্পষ্ট হবে। কবিতা বিশ্লেষণ করার সময় কবিতাটি খুব ধীরস্থির ভাবে আবৃতি করার চেষ্টা করুন এবং নিয়ম মত পর্বে বিভক্ত করুন। এরপর মাত্রায় বিশ্লেষণ করে প্রতি মাত্রার জন্য প্রথমে একমাত্রা হিসাব করুন। এতে যদি প্রতিটি আনুসঙ্গিক পর্বে মাত্রা সংখ্যা সমান হয়ে যায় তাহলে সিদ্ধান্ত হবে স্বরবৃত্ত ছন্দ। আর যদি এতেও না মিলে, তবে শব্দের শেষের বদ্ধাক্ষর গুলোতে দুইমাত্রা বসান। মিলে গেলে অক্ষরবৃত্ত ছন্দ। ধরুন এতেও মেলেনি, তাহলে সকল বদ্ধাক্ষরে দুইমাত্রা বসান মিলেগেলে মাত্রাবৃত্ত ছন্দ। কোন কোন সময় এক মাত্রা কম বা বেশি হতে পারে। এতে দুশ্চিন্তার কোন কারন নেই। যদি বলার ভঙ্গি দিয়ে এ ত্রুটি দূর করা যায়, তবে ছন্দ ঠিক বলে ধরে নেয়া যেতে পারে। বলার বা আবৃতি করার সময় লয় এদিক সেদিক করা যাবে না। এতে ছন্দ সংক্রান্ত সঠিক সিদ্ধান্ত নাও পাওয়া যেতে পারে। ছন্দ বোঝাটা আপনার অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর করে। তাই বেশি বেশি কবিতা পড়ুন এবং সেগুলো বিশ্লেষণ করে দেখুন। একটি জিনিস সব সময় মাথায় রাখবেন, একটি সন্তানের যেমন একজনই মা থাকেন, তেমনি একটি কবিতার ও একটি ছন্দ থাকবে। আবার এও মাথায় রাখতে হবে, মা ছাড়া যেমন কোন সন্তান থাকা সম্ভব নয়, ঠিক তেমনি ছন্দ ছাড়াও কোন কবিতা হতে পারে না। সুতরাং, আমরা যখন কোন কবিতা বা গান রচনা করব, তখন অবশ্যই তাকে কোন না কোন ছন্দের অন্তর্ভূক্ত হতে হবে। তাই ঠিক মত বুঝে কবিতা রচনা করুন।

        এই লেখাটিতে, আমি আপনাদের সাথে আমার ছন্দ বিষয়ক সামান্য জ্ঞানের কিছু অংশ ভাগাভাগি করে নেয়ার চেষ্টা করেছি। আমি আমার সাধ্যমত সহজ ভাবে আপনাদের বাংলা কবিতার ছন্দ শেখানোর চেষ্টা করেছি। জানি না কতটুকু পেরেছি। তবে আমার এই প্রচেষ্টা তখনই সার্থক হবে, যখন আপনারা ছন্দ না বুঝে আর কবিতা রচনা করবেন না এবং নিয়ম গুলো আপনাদের আয়ত্তে আনবেন। আর এর জন্য বেশি বেশি কবিতা আবৃতি এবং পরিপূর্ণ বিশ্লেষণের কোন বিকল্প নেই। শুধুমাত্র আমার কথা গুলোকেই ছন্দ শেখার জন্য পরিপূর্ণ বলে মনে করার কোন কারণ নেই। এজন্য আরো বেশি বেশি বই পড়ুন, আরো বেশি জানুন এবং সুন্দর, সুষ্টু ও সাবলিল কবিতা বা গান রচনা করে বাংলা সাহিত্যকে আরো সমৃদ্ধ করুন। আর সবচেয়ে বড় কথা হল, এই কথাটি বোঝানই ছিল আমার লেখাটির প্রধান উদ্দেশ্য।

53 comments:

  1. ভাই অসাধারন এবং অনেক কাজের একটি লেখা।অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।তবে আমার একি অক্ষরে দুটি মাত্রার ব্যাপারটা বুঝতে ঝামেলা হচ্ছে।আপনার কাছে মাত্রা নিয়ে আর একটু আলোচনা এবং এ সংক্রান্ত কিছু বই এর নাম চাই।এমন একটি লেখার জন্য আপনাকে সেলুট।আমার ইমেইল:tokaisetu@gmail.com

    ReplyDelete
  2. লেখাটি পড়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আমার মনে হয় আপনার অক্ষর বুঝতে সমস্যা হচ্ছে। আপনি আক্ষর অংশটি আবার পড়ুন এবং বোঝার চেষ্টা করুন। কোন প্রশ্ন থাকলে আমাকে জিজ্ঞাসা করুন। আপনি আমার সাথে আলোচনা করতে পারেন বা "মাহবুব আলম" বা "মুনিরুজ্জামান" স্যারের ছন্দের বই পড়তে পারেন। আমি আমার সাধ্য মত সাহায্য করবো। ধন্যবাদ ভাই......

    ReplyDelete
  3. লেখাটি পড়ে উপকৃত হলাম ।ধণ্যবাদ

    ReplyDelete
  4. আপনার মন্তব্য লিখুন...ধন্যবাদ।

    ReplyDelete
  5. অসাধারন লিখেছেন ভাই।বিষয় টা পরিষ্কার হয়ে গেল

    ReplyDelete
  6. আমি এখন থেকেই এই ক্লাসে ভর্তি হলাম। এই পর্বটি পড়া এবং শেখা আমার জন্যে খুব জরুরী।

    ReplyDelete
    Replies
    1. লেখাটি আপনার কাজে লাগছে, শুনে ভালো লাগলো।

      Delete
  7. অসাধারন লিখেছেন, বোঝানোর কৌশলটা অতি উত্তম।
    অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।

    ReplyDelete
    Replies
    1. আপনাকেও ধন্যবাদ।

      Delete
  8. অনেক ধন্যবাদ

    ReplyDelete
  9. অনেক ভালো লাগলো।
    ধন্যবাদ

    ReplyDelete
  10. লেখাটি খুব ভালো, কিন্তু ছন্দে যে লয় ব্যবহৃত হয় তার প্রাধান্য দেখতে পেলাম না কেন?

    ReplyDelete
    Replies
    1. মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। আসলে ছন্দে লয় ব্যবহৃত হয় এভাবে না বলে আমরা বলতে পারি, প্রতিটি ছন্দে কবিতাগুলো লয় মেনে চলে। যেমন, স্বরবৃত্ত ছন্দের কবিতাগুলো স্বাধারণত দ্রূত লয়েরই হয়ে থাকে। যেহেতু যারা ছন্দ শিখছেন, লয় তাদের জন্য একটি নতুন শব্দ। তাই আসলে লয় শব্দটি না বলে বলা হয়েছে, 'সাধারণত ছড়া জাতীয় কবিতাগুলো স্বরবৃত্ত ছন্দের হয়' বা 'সাধারণত গীতিকবিতা গুলো মাত্রাবৃত্ত ছন্দের হয়ে থাকে'।

      Delete
  11. এই লেখাটা সকলের পড়া উচিৎ । লেখক কে অনেক ধন্যবাদ ।

    ReplyDelete
    Replies
    1. মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।

      Delete
  12. অসংখ্য ধন্যবাদ। ছন্দ সংক্রান্ত আপনার উল্লিখিত বই দুটি কোথায় পাওয়া যাবে?

    ReplyDelete
    Replies
    1. মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
      ঢাকা নিউমার্কেটে খোঁজ নিয়ে দেখুন। আশা করি পেয়ে যাবেন।

      Delete
  13. ভাই অসংখ্য ধন্যবাদ।পড়ে অনেক উপকৃত হলাম।

    ReplyDelete
    Replies
    1. আপনাকেও ধন্যবাদ।
      আপনার উপকারে এসেছে, জেনে ভাল লাগলো।

      Delete
  14. অতি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা যা, আমার জন্য প্রয়োজন ছিল।
    ধন্যবাদ লেখককে।
    ধারাবাহিকতা চাই।

    ReplyDelete
    Replies
    1. আপনার মতামতের জন্য অনেক ধন্যবাদ।

      Delete
  15. সত্যিই খুব ভাল লাগল,তবে আমাকে আরেকটু এগুতে হবে,তাই সহযোগিতার কাম্য।

    ReplyDelete
  16. ধন্যবাদ ভাই। স্বচ্ছ ধারনা পেলাম।

    ReplyDelete
  17. অনেক উপকৃত হলাম,,,,,ধন্যবাদ

    ReplyDelete
  18. ভাই আপনার লেখার কৌশল টা কিন্তু ভুলার মত না,বেশ উপকার হলাম ধন্যবাদ আপনাকে,,
    আপনাকে দেখতে ইচ্ছা হচ্ছে,,আপনি মনে হয় পাঠকের হৃদয়েই থাকেন, কেমনে পাঠকের মনের প্রশ্ন গুলা উত্তর দিলেন?

    ReplyDelete
    Replies
    1. আপনার কমেন্টের জন্য অনেক ধন্যবাদ।
      Share করে সাথে থাকুন।

      Delete
  19. আপনার পোস্টটি খুব সুন্দর হয়েছে।এত সুন্দর তথ্য শেয়ার করার জন্য ধন্যবাদ।

    আমার ও একটি সাইট আছে যেখানে আমি সবাইকে ইংরেজি শেখায়।
    www.mojarenglish.com


    ReplyDelete
    Replies
    1. কমেন্টের জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
      আপনার উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসার যোগ্য।

      Delete
  20. This comment has been removed by the author.

    ReplyDelete
  21. This comment has been removed by the author.

    ReplyDelete
  22. আপনার পোষ্টটি পড়ে উপকৃত হলাম ও ভালো লাগলো।

    ReplyDelete
  23. খুব ভালো লিখেছেন। একটা স্বচ্ছ ধারণা পেলাম।আপনার প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানাই।

    ReplyDelete
  24. This comment has been removed by the author.

    ReplyDelete
  25. লেখাটি অনেক ভালো লেগেছে । এত সহজ ও সুন্দর করে বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য কৃতজ্ঞ।

    ReplyDelete
  26. This comment has been removed by the author.

    ReplyDelete
  27. অনেক ধন্যবাদ,এত সুন্দর লেখা ছন্দ নিয়ে খুব কম আছে।

    ReplyDelete
  28. আপনার ছন্দের বিশ্লেষণটা পড়ে অত্যন্ত উপকৃত হলাম।

    ReplyDelete
  29. আপনার লেখা পড়ে অনেক সমৃদ্ধ হলাম। ধন্যবাদ। আমি একটু আধটু গান/কৃবিতা লিখি। কিন্তু ছন্দ ও মাত্রা সম্বন্ধে খুব বেশি জ্ঞান নেই। একটা গান পাঠাব, দয়া করে একটু সময় করে দেখে বলবেন ঠিক হয়েছে কিনা। আপনি বললে পাঠাব। দেখে দিলে কৃতজ্ঞ থাকব। ধন্যবাদ।--অনিল কুমার রাণা, কোলাঘাট, পূর্ব মেদিনীপুর, পশ্চিমবঙ্গ।

    ReplyDelete
  30. কবিতার ছন্দ ও মাত্রা শেখার জন্য

    সংগ্রহ এ রাখার মতো একটি বইয়ের নাম জানালে উপকৃত হতাম।


    ReplyDelete
  31. প্রেমের ছন্দ এর মতো পড়ে খুব ভালো লাগলো।

    ReplyDelete
  32. Thank you indeed for a easy and simple discussion! Other stuff on this in web and YouTube is difficult.

    ReplyDelete